Friday, 30 October 2015

Concept of Vadoriya Jhumur .

ভাদরিয়া ঝুমুর 
অথবা 
ভাদুরিয়া ঝুমুর 


ভাদরিয়া বা ভাদুরিয়া ঝুমুরকে  কেউ কেউ করম নাচের গান বা পাঁতাশালিয়া গীতের সঙ্গে এক করে দেখেছেন। কেউ বা বলেন , ভাদ্রমাসে অনুষ্ঠিত গীতের নাম ভাদরিয়া ঝুমুর। অস্বীকার করবার উপায় নেই , কোথাও কোথাও ভাদ্রমাসে অনুষ্ঠিত করম নাচের গানকে  ভাদর্র্যা বা ভাদরিয়া গীতি বলা হয়। আমরা স্বীকার করি , উল্লিখিত ব্যাখাগুলোর যথেষ্ট গুরুত্ব আছে। তবু আমরা ভাদরিয়া ঝুমুর নামটিই গ্রহণযোগ্য বলে মনে করি। সাধারন ঝুমুর এবং ভাদরিয়া ঝুমুরের মধ্যে বিষয়বস্তুর দিক দিয়ে কোন পার্থক্য নেই।  লৌকিক প্রেম এবং রাধাকৃষ্ণ- প্রণয়লীলা উভয় শ্রেনীর ঝুমুরেরই বিষয়বস্তু। এই দুই শ্রেনীর ঝুমুরের মধ্যে মূল পার্থক্য গানের রচনাশৈলী বা গঠন ভঙ্গিতে এবং সুরে। আসলে ঝুমুরের একটি বিশিষ্ট সুরের নাম ভাদরিয়া , যেমন তামাড় অঞ্চলে প্রচলিত সুরের নাম তামাড়িয়া এবং সেই সুরের ঝুমুরকে কেউ কেউ তামাড়িয়া ঝুমুর বলবার পক্ষপাতী। ভাদরিয়া ঝুমুরের সুর দ্রুত এবং উচ্ছল হয়ে থাকে ; এ সুরকে 'রঙ্গিন ' বলা হয় এই কারনেই। করম নাচের গানের সুরের উন্নত রূপ এই ভাদরিয়া সুর। তাছাড়া রচনাশৈলীর দিক দিয়ে এ গান ক্ষুদ্রতর পদের সাহায্যে গঠিত হয় এবং সাধারন ঝুমুর থেকে আয়তনেও ছোট হয়ে থাকে। গঠনরীতিতে যা সহজেই দৃষ্টি আকর্ষন করে , তা হল প্রতি কলির দ্বিতীয় পঙক্তি। এই দ্বিতীয় পঙক্তির গোড়ায় সাধারনত চার অক্ষরের পরে একটি যতি বা স্বল্প বিরতি থাকে , গায়ন রীতির দিক দিয়ে একে 'সম' বলা যেতে পারে। নিম্নোদ্ধৃত গান গুলো লক্ষ্য করে দেখলেই  আমাদের বক্তব্য পরিস্কার বোঝা যাবে। 

১.  ঘনঘটা রাতিয়া চমকে বিজলিয়া /          থাকি থাকি ,/জলে বিরহ আগুনিয়া। 
     কোথা আছ প্রিয়তম দেখ না                    আসিয়া / অদর্শনে ,আছি মরমে            মরিয়া।।
     অঙ্গ কাঁপে থরথর হানে রতিপতিয়া /      বিফলেতে ,গেল যৌবন বহিয়া ।
     ভারত কিশোরে বলে থাক ধৈর্য              ধরিয়া    /পুরাইব , আশা বদন                চুমিয়া। ।

২.  সারা নিশি রইলাম বসি বকুলতলায়      গো / কমলিনী , ধনি তোমার আশায়      গো। / শীতলী বাতাস বহে শীতে            কাঁপে গা গো। / সাড়া নাহি , সে ত          ডাকে ইশারায় গো। / আর কি                বিশ্বাস হয় তোমারি কথায় গো /            নরোত্তমায়, ও বাদ সাধিলে আমায়          গো ।।

৩.  পিয়া পিয়া বলিয়া কাঁদত বিনোদিয়া       / শুনা ভেল , মোর গোকুল নগরিয়া।       আসিব বলিয়া পিয়া গেল ছাড়িয়া /         দিবানিশি , ধনি রহল নিরখিয়া ।।         অবলা জাতিয়া কেইসে হিয়া /মনে         পড়ে ,কালার নবীন পিরিতিয়া। বিষ্টু        অনাথে ভণে মনে মনে খুঁজিয়া /              প্রাণনাথ ,মম প্রাণ গেল হরিয়া ।।

৪.  শীত লানিল হিল্লোলে তরুকোলে            লতা দোলে / মেঘকোলে ,দোলে              সোহাগে চপলা গো। / নীরদঘটা              নিরখি নাচিছে শিখিনী - শিখী /            সেহ দেখি , বাড়ে বিরহের জ্বালা গো।      / আমি শ্যাম বিরহিনী কাঁদি                  দিবসরজনী / একাকিনী , ভুলি                বিরহের খেলা গো। / ললিতা কয়            রাধায় দ্বিজ ভবপ্রীতা গায় / পাবে            শ্যাম , রাই হয়ো না উতলা গো ।।

৫.  কোকিলার ডাক শুনি নিজমনে ভাবি      গুণি / আমার কলপি - কলপি উঠে          ছাতি রে ,/ ওরে পাখি , কেন ডাক            নিশিভোর রাতি। / দিবানিশি কেঁদে        মরি না আসিল বংশীধারী / আমার        ঝর ঝর ঝরে দুটি আঁখি রে। /নিশি          হল অবসান না আসিল বাঁকা শ্যাম /      শ্যাম আমায় দিয়ে গেল প্রেমে ফাঁকি      রে। / সুন্দর বলে গুন গো রাধা তুমি          যে     প্রাণের আধা /শ্যাম এসে                মুছাবে দুটি আঁখি রে ।।



কৃতজ্ঞতা স্বীকার --
ঝাড়খন্ডের লোক সাহিত্য 
(বঙ্কিমচন্দ্র মাহাত ) 

Sunday, 18 October 2015

Karam Dance.

করম  নৃত্য 


করম নাচ বিভিন্ন নামে পরিচিত। দাঁড়শাল্যা , দাঁড়ঝুমুর , পাতাশাল্যা , ঝিঙাফুল্যা ইত্যাদি। প্রথম চারটি নামে  'দাঁড় ' শব্দটি আদিতে সাধারণ শব্দ হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছে। 'দন্ড' শব্দ থেকে 'দাঁড়' শব্দের উদ্ভব, দন্ডায়মান অবস্থায় যে নৃত্য তার নাম দাঁড় নাচ। দাঁড় নাচের গান দাঁড়ঝুমুর নামেও পরিচিত। করম নাচ শ্লথ এবং দ্রুত উভয় গতিতে হয়ে থাকে। তবে দ্রুত  গতির প্রাধান্যই বেশি। সম্প্রদায় বিশেষে এই নাচে যথেষ্ট তারতম্য রয়েছে। খারিয়াদের করম নাচ অত্যন্ত দ্রুত লয়ের হয়ে থাকে। এক আদিম উদ্দামতা এবং উল্লাস যেন তাদের নৃত্যের মধ্যে দিয়ে পরিস্ফুট হয়ে ওঠে। এ-নৃত্য প্রায় দৌড়ানোর পর্যায়েই পড়ে। 

করম নাচের গানগুলো আকারে যেমন ক্ষুদ্র , তেমনি গায়ন-কাল ও সীমিত। এক কলি , দু'কলির গান ,একবার দুবার আবৃত্তির পরই শেষ হয় , আরম্ভ হয় নতুন গান। এ গানের শেষ নেই , উদ্দাম নৃত্যেরও শেষ নেই। অক্লান্ত ,অশ্রান্ত নৃত্য গীতির আসর সারারাত্রি জমজমাট হয়ে থাকে। অনেকে এইসব গান ও নাচের মধ্য দিয়ে আধ্যাত্মিকতার উপলব্ধিও করে থাকেন।

এই অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়েই একদিন আদিবাসী সমাজ জীবনের সখা কিংবা সখীত্ব পাতানো হত , অর্থাৎ স্বামী - স্ত্রী নির্বাচন করা হত বলে একে পাতানাচ  ও বলে। করম পরব উপলক্ষ্যে পাতা শুদ্ধ ডালকে কেন্দ্র করে নাচ হয় বলেও এর নাম পাতানাচ। করম পরবকে কেন্দ্র করে যে নৃত্য তা করম নৃত্যই। ভাদ্রের একাদশীতে এই পরব হলেও আয়োজন চলতে থাকে অনেক দিন আগে থেকে। নৃত্যের আসর বসে প্রতি সন্ধ্যায় শ্রাবণ মাস থেকেই , চলে মধ্যরাত্রি অবধি। করম ডাল পুঁতে পুজো করা হয় এবং নৃত্যগীত অনুষ্ঠিত হয়।

এই নৃত্যে স্ত্রী ও পুরুষ উভয়ই যোগ দিয়ে থাকে। প্রধানত এটি কুমারী নৃত্য , অবিবাহিত মেয়েদের অবাধ স্বাধীনতা করম পরবে। তবে সধবারাও এই নৃত্যে অংশগ্রহণ করে। পরবের প্রায় দিন দশেক আগে থেকে প্রতি সন্ধ্যায় কুলিতে বা গ্রামের পথে ও আখড়ায় মিলিত হন মেয়েরা হাত ধরাধরি করে , গায়ে গা  ঠেঁকিয়ে মৃদুতালে শুরু করেন নাচ -

   "সাঁঝে ফুটে ঝিঙা ফুল সকালে মলিন 
    আজ কেনে বঁধুর বদন মলিন হে ?"

পাড়ায় পাড়ায় করম ডাল এনে দেবতার প্রতীক রূপে পূজা করা হয়। ডালায় যব ,ভুট্টা রাখা হয়। অনুষ্ঠান শেষে নব অঙ্কুরিত বীজ গাছের চারা প্রীতিসম্ভাষন জানাতে পরস্পর একে অপরের কানে গোঁজে।

করম অন্যতম শ্রেষ্ঠ শষ্যউৎসব। নৃত্য - গীত এর মূল অনুষঙ্গ। নৃত্য - গীতি বাদ দিয়ে করম ব্রতের আয়োজন কল্পনাই করা যায় না। করম নাচে শরীরের যে অঙ্গভঙ্গি প্রকাশ পায় , তাতে ধান্যারোপনের জন্য মাটি কাদা করা, ধান্যরোপন , ধান্যচ্ছেদন আদি বিভিন্ন মুদ্রা প্রকাশ পেয়ে থাকে।

যেসব করম গানের সঙ্গে নৃত্য প্রদর্শন করা হয় সেগুলি হল -

১.  মহলের ভিতরে থাকি জানালায়                নয়ন রাখি 
       আমি শুব জানালার গড়াতে ,
        খোঁচা দিয়ে উঠাবে আমাকে ;

২.  উঠিল পুন্নিমার চাঁদ দেশ হল্য আল রে ,
      রাজা ,এই চাঁদে অযধ্যা শিকার।
এখানে বলা হয়েছে আদিম মানুষ শিকার নির্ভরশীল ছিল। অযোধ্যা পাহাড় শিকারের প্রশস্ত অঞ্চল ছিল।

৩.  কিংবা লয়ে আলি রে মন কিবা লয়ে          যাবি ,
       এমন সুন্দর দেহ মাটিতে মিশাবি ,
       রে মন , এ ভব সংসার ছারি যাবি। 
এখনে বলা হয়েছে জীবন বড়ই ক্ষণস্থায়ী , একথা জেনেও মানুষ হতাশ হয় না। বরং তারা হাসে , গায় , নাচে। তারা ঈশ্বরে বিশ্বাসী ; ঈশ্বর যা বিহিত করবেন , তাই হবে। তাই বলে উপবাসী রেখে কৃচ্ছ্র সাধনায় প্রানের সমস্ত কোলাহলকে নিস্তব্ধ করে দিতে হবে , তা তারা স্বীকার করে না।

কৃতজ্ঞতা স্বীকার -
 ঝাড়খন্ডের লোক সাহিত্য
 (বঙ্কিমচন্দ্র মাহাত )

      



Tuesday, 6 October 2015

Karam song...

           করম গীতি
              https://youtu.be/n7fL6jCQj8I
বর্ষাকালীন এক প্রকার শস্য উৎসব এর  নাম করমউৎসব। ভাদ্র মাসের শুক্ল পক্ষের একাদশীতে সমগ্র পশ্চিম সীমান্ত বাংলার জনসমাজ করম পরবে মেতে ওঠে। সন্ধ্যার প্রাক্কালে পার্শ্ববর্তী বন থেকে করম গাছের দুটি শাখা কেটে নিয়ে আসে তরুণীরা। সারা পথ ধরে করম ঠাকুরের গান ধ্বনিত হতে থাকে। দুটি শাখাকে গ্রামের কোনো মধ্যবর্তী স্থানে কাঁচা মাটির বেদির উপর পুঁতে দেওয়া হয়। তারপর সারারাত ধরে চলে নাচ আর গান। এর নাম হলো করম গীতি। মূলত আদিবাসীদের পরব বলে এ গান নৃত্য বহুল। করম গানের সহযোগী নাচকে বলা হয় করম নাচ। অদিবাসী সম্প্রদায়ের মধ্যে এই পরব অবশ্যকৃত। এই গানকে দাঁড়শালিয়া নামেও অভিহিত করা হয়। এ গান যেন সঙ্গীত জগতের আদিম সঙ্গীত। বিনোদন নয় - নানারকম জাদু বিশ্বাস থেকে এর জন্ম। মাত্র দুটি চরণ ও চারটি মাত্রার উপর প্রতিষ্ঠিত এই গান দ্রুত তালের। সারারাত ধরে মাদলের ধিং ধিতাং ধিতাং - বোলের সঙ্গে সমতলে চলে পদক্ষেপণ এবং সুরক্ষেপন। সাধারনত নারীরা এই গানের ধারক। এই গানে থাকে জীবন ও সমাজের বিচিত্র অনুভূতির কথা। যা তাদের জীবনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী ভাবে যুক্ত থাকে। 
  কথা গুলি হলো :- 

ক> আদারে বাদাড়ে ঝিঙ্গা ঝিঙ্গায় শুধুই 
                                             জালি হে ,
      ননদ মাগী ছল ছল তুলে ডালি ডালি        হে। 

খ > বাঁধ বাঁধালে না বাঁধালে ঘাট হে ,
       ডালিম লাগাই বধু গেল পর দেহ               হে।

গ > পাকিল ফাটিল ডালিম চোরে তুলে 
                                          খায় হে। 

ঘ > এমন সময় বঁধু ঘরে আমার নাই হে 
       একদিনকার হলেদ বাঁটা দুদিনকার 
                                       বাসি লো ,
       মা বাপকে বল্যে দিহ , বেজাঞ্চ সুখে 
                                            আছি লো।


এসব গানের ভাষা এবং ভাব অকৃত্রিম। 
তাই তো অবলীলায় বলতে পারে  :-

      বাসি ভাতে নুন লঙ্কা লুচির মজা 
                                         পুরি হে। 
      নৌতন পিরিতির মজা চোখ ঠরাঠরি       হে। 

কিংবা , এখানে উল্লেখ করতে পারি -

           আমার বঁধু হাল করে কেঁদে কানালির ধারে। হায় হায় - মাথার ঘাম চোখে পড়ে ,
         দেখি হিয়া ফাটে। 
ননদিনী লো , আমি নিজে যাব 'কাসিয়াম ' দিতে। 

এখানে শ্রেণী সমাজের সুখ - দুঃখ , হাসি - কান্না , আনন্দ - উচ্ছাসের বহি:প্রকাশ। এই গানে সমাজে বাস্তবধর্মী জীবনচিত্র ফুটে ওঠে। 

করম নাচের গানে আছে -
         
           ' সাঁঝে ফুঁটে ঝিঙ্গাফুল
             সকালে মলিন 
              আজ কেনে বঁধুর 
              বদন মলিন হে ?
             সাঁঝে ফুটে ঝিঙ্গাফুল 
             সকালে মলিন।'

অর্থাৎ ঝিঙ্গাফুলের সৌন্দর্য যেমন ক্ষণস্থায়ী , মানব জীবন ও তেমনি ক্ষণস্থায়ী। এই ক্ষণস্থায়ী জীবনকে আনন্দময় করে তোলাই মানব জীবনের অন্যতম লক্ষ্য। ঝিঙ্গাফুলের সৌন্দর্যময় অস্তিত্ব যেমন ক্ষণস্থায়ী করম গানের আকারও তেমনি ক্ষুদ্র। এই ক্ষুদ্র আয়তনের মধ্যে জীবনের সামগ্রিক রূপ পরিস্ফুট করে তোলাই করম গীতির অন্যতম বৈশিষ্ট বলে একে ঝিঙ্গা গীতিও বলা হয়ে থাকে।  
নৃত্য গীতির অনুষ্ঠানের জন্য ঝাড়খন্ডের প্রতি গ্রামেই একটি করে আখড়া থাকে। কর্মক্লান্ত দিনের শেষে আখড়া প্রাঙ্গনে সবাই সমবেত হলে বন্দনা গীতির মাধ্যমে নৃত্যানুষ্ঠানের সূচনা করা হয়। বন্দনা গীতির পর গায়কের নিজেদের ইচ্ছামত গান নির্বাচন করেন।


কৃতজ্ঞতা স্বীকার - লোকয়ত ঝাড়খন্ড (ড : বিনয় মাহাত )