ভাদরিয়া ঝুমুর
অথবা
ভাদুরিয়া ঝুমুর
ভাদরিয়া বা ভাদুরিয়া ঝুমুরকে কেউ কেউ করম নাচের গান বা পাঁতাশালিয়া গীতের সঙ্গে এক করে দেখেছেন। কেউ বা বলেন , ভাদ্রমাসে অনুষ্ঠিত গীতের নাম ভাদরিয়া ঝুমুর। অস্বীকার করবার উপায় নেই , কোথাও কোথাও ভাদ্রমাসে অনুষ্ঠিত করম নাচের গানকে ভাদর্র্যা বা ভাদরিয়া গীতি বলা হয়। আমরা স্বীকার করি , উল্লিখিত ব্যাখাগুলোর যথেষ্ট গুরুত্ব আছে। তবু আমরা ভাদরিয়া ঝুমুর নামটিই গ্রহণযোগ্য বলে মনে করি। সাধারন ঝুমুর এবং ভাদরিয়া ঝুমুরের মধ্যে বিষয়বস্তুর দিক দিয়ে কোন পার্থক্য নেই। লৌকিক প্রেম এবং রাধাকৃষ্ণ- প্রণয়লীলা উভয় শ্রেনীর ঝুমুরেরই বিষয়বস্তু। এই দুই শ্রেনীর ঝুমুরের মধ্যে মূল পার্থক্য গানের রচনাশৈলী বা গঠন ভঙ্গিতে এবং সুরে। আসলে ঝুমুরের একটি বিশিষ্ট সুরের নাম ভাদরিয়া , যেমন তামাড় অঞ্চলে প্রচলিত সুরের নাম তামাড়িয়া এবং সেই সুরের ঝুমুরকে কেউ কেউ তামাড়িয়া ঝুমুর বলবার পক্ষপাতী। ভাদরিয়া ঝুমুরের সুর দ্রুত এবং উচ্ছল হয়ে থাকে ; এ সুরকে 'রঙ্গিন ' বলা হয় এই কারনেই। করম নাচের গানের সুরের উন্নত রূপ এই ভাদরিয়া সুর। তাছাড়া রচনাশৈলীর দিক দিয়ে এ গান ক্ষুদ্রতর পদের সাহায্যে গঠিত হয় এবং সাধারন ঝুমুর থেকে আয়তনেও ছোট হয়ে থাকে। গঠনরীতিতে যা সহজেই দৃষ্টি আকর্ষন করে , তা হল প্রতি কলির দ্বিতীয় পঙক্তি। এই দ্বিতীয় পঙক্তির গোড়ায় সাধারনত চার অক্ষরের পরে একটি যতি বা স্বল্প বিরতি থাকে , গায়ন রীতির দিক দিয়ে একে 'সম' বলা যেতে পারে। নিম্নোদ্ধৃত গান গুলো লক্ষ্য করে দেখলেই আমাদের বক্তব্য পরিস্কার বোঝা যাবে।
১. ঘনঘটা রাতিয়া চমকে বিজলিয়া / থাকি থাকি ,/জলে বিরহ আগুনিয়া।
কোথা আছ প্রিয়তম দেখ না আসিয়া / অদর্শনে ,আছি মরমে মরিয়া।।
অঙ্গ কাঁপে থরথর হানে রতিপতিয়া / বিফলেতে ,গেল যৌবন বহিয়া ।
ভারত কিশোরে বলে থাক ধৈর্য ধরিয়া /পুরাইব , আশা বদন চুমিয়া। ।
২. সারা নিশি রইলাম বসি বকুলতলায় গো / কমলিনী , ধনি তোমার আশায় গো। / শীতলী বাতাস বহে শীতে কাঁপে গা গো। / সাড়া নাহি , সে ত ডাকে ইশারায় গো। / আর কি বিশ্বাস হয় তোমারি কথায় গো / নরোত্তমায়, ও বাদ সাধিলে আমায় গো ।।
৩. পিয়া পিয়া বলিয়া কাঁদত বিনোদিয়া / শুনা ভেল , মোর গোকুল নগরিয়া। আসিব বলিয়া পিয়া গেল ছাড়িয়া / দিবানিশি , ধনি রহল নিরখিয়া ।। অবলা জাতিয়া কেইসে হিয়া /মনে পড়ে ,কালার নবীন পিরিতিয়া। বিষ্টু অনাথে ভণে মনে মনে খুঁজিয়া / প্রাণনাথ ,মম প্রাণ গেল হরিয়া ।।
৪. শীত লানিল হিল্লোলে তরুকোলে লতা দোলে / মেঘকোলে ,দোলে সোহাগে চপলা গো। / নীরদঘটা নিরখি নাচিছে শিখিনী - শিখী / সেহ দেখি , বাড়ে বিরহের জ্বালা গো। / আমি শ্যাম বিরহিনী কাঁদি দিবসরজনী / একাকিনী , ভুলি বিরহের খেলা গো। / ললিতা কয় রাধায় দ্বিজ ভবপ্রীতা গায় / পাবে শ্যাম , রাই হয়ো না উতলা গো ।।
৫. কোকিলার ডাক শুনি নিজমনে ভাবি গুণি / আমার কলপি - কলপি উঠে ছাতি রে ,/ ওরে পাখি , কেন ডাক নিশিভোর রাতি। / দিবানিশি কেঁদে মরি না আসিল বংশীধারী / আমার ঝর ঝর ঝরে দুটি আঁখি রে। /নিশি হল অবসান না আসিল বাঁকা শ্যাম / শ্যাম আমায় দিয়ে গেল প্রেমে ফাঁকি রে। / সুন্দর বলে গুন গো রাধা তুমি যে প্রাণের আধা /শ্যাম এসে মুছাবে দুটি আঁখি রে ।।
কৃতজ্ঞতা স্বীকার --
ঝাড়খন্ডের লোক সাহিত্য
(বঙ্কিমচন্দ্র মাহাত )