Sunday, 18 October 2015

Karam Dance.

করম  নৃত্য 


করম নাচ বিভিন্ন নামে পরিচিত। দাঁড়শাল্যা , দাঁড়ঝুমুর , পাতাশাল্যা , ঝিঙাফুল্যা ইত্যাদি। প্রথম চারটি নামে  'দাঁড় ' শব্দটি আদিতে সাধারণ শব্দ হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছে। 'দন্ড' শব্দ থেকে 'দাঁড়' শব্দের উদ্ভব, দন্ডায়মান অবস্থায় যে নৃত্য তার নাম দাঁড় নাচ। দাঁড় নাচের গান দাঁড়ঝুমুর নামেও পরিচিত। করম নাচ শ্লথ এবং দ্রুত উভয় গতিতে হয়ে থাকে। তবে দ্রুত  গতির প্রাধান্যই বেশি। সম্প্রদায় বিশেষে এই নাচে যথেষ্ট তারতম্য রয়েছে। খারিয়াদের করম নাচ অত্যন্ত দ্রুত লয়ের হয়ে থাকে। এক আদিম উদ্দামতা এবং উল্লাস যেন তাদের নৃত্যের মধ্যে দিয়ে পরিস্ফুট হয়ে ওঠে। এ-নৃত্য প্রায় দৌড়ানোর পর্যায়েই পড়ে। 

করম নাচের গানগুলো আকারে যেমন ক্ষুদ্র , তেমনি গায়ন-কাল ও সীমিত। এক কলি , দু'কলির গান ,একবার দুবার আবৃত্তির পরই শেষ হয় , আরম্ভ হয় নতুন গান। এ গানের শেষ নেই , উদ্দাম নৃত্যেরও শেষ নেই। অক্লান্ত ,অশ্রান্ত নৃত্য গীতির আসর সারারাত্রি জমজমাট হয়ে থাকে। অনেকে এইসব গান ও নাচের মধ্য দিয়ে আধ্যাত্মিকতার উপলব্ধিও করে থাকেন।

এই অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়েই একদিন আদিবাসী সমাজ জীবনের সখা কিংবা সখীত্ব পাতানো হত , অর্থাৎ স্বামী - স্ত্রী নির্বাচন করা হত বলে একে পাতানাচ  ও বলে। করম পরব উপলক্ষ্যে পাতা শুদ্ধ ডালকে কেন্দ্র করে নাচ হয় বলেও এর নাম পাতানাচ। করম পরবকে কেন্দ্র করে যে নৃত্য তা করম নৃত্যই। ভাদ্রের একাদশীতে এই পরব হলেও আয়োজন চলতে থাকে অনেক দিন আগে থেকে। নৃত্যের আসর বসে প্রতি সন্ধ্যায় শ্রাবণ মাস থেকেই , চলে মধ্যরাত্রি অবধি। করম ডাল পুঁতে পুজো করা হয় এবং নৃত্যগীত অনুষ্ঠিত হয়।

এই নৃত্যে স্ত্রী ও পুরুষ উভয়ই যোগ দিয়ে থাকে। প্রধানত এটি কুমারী নৃত্য , অবিবাহিত মেয়েদের অবাধ স্বাধীনতা করম পরবে। তবে সধবারাও এই নৃত্যে অংশগ্রহণ করে। পরবের প্রায় দিন দশেক আগে থেকে প্রতি সন্ধ্যায় কুলিতে বা গ্রামের পথে ও আখড়ায় মিলিত হন মেয়েরা হাত ধরাধরি করে , গায়ে গা  ঠেঁকিয়ে মৃদুতালে শুরু করেন নাচ -

   "সাঁঝে ফুটে ঝিঙা ফুল সকালে মলিন 
    আজ কেনে বঁধুর বদন মলিন হে ?"

পাড়ায় পাড়ায় করম ডাল এনে দেবতার প্রতীক রূপে পূজা করা হয়। ডালায় যব ,ভুট্টা রাখা হয়। অনুষ্ঠান শেষে নব অঙ্কুরিত বীজ গাছের চারা প্রীতিসম্ভাষন জানাতে পরস্পর একে অপরের কানে গোঁজে।

করম অন্যতম শ্রেষ্ঠ শষ্যউৎসব। নৃত্য - গীত এর মূল অনুষঙ্গ। নৃত্য - গীতি বাদ দিয়ে করম ব্রতের আয়োজন কল্পনাই করা যায় না। করম নাচে শরীরের যে অঙ্গভঙ্গি প্রকাশ পায় , তাতে ধান্যারোপনের জন্য মাটি কাদা করা, ধান্যরোপন , ধান্যচ্ছেদন আদি বিভিন্ন মুদ্রা প্রকাশ পেয়ে থাকে।

যেসব করম গানের সঙ্গে নৃত্য প্রদর্শন করা হয় সেগুলি হল -

১.  মহলের ভিতরে থাকি জানালায়                নয়ন রাখি 
       আমি শুব জানালার গড়াতে ,
        খোঁচা দিয়ে উঠাবে আমাকে ;

২.  উঠিল পুন্নিমার চাঁদ দেশ হল্য আল রে ,
      রাজা ,এই চাঁদে অযধ্যা শিকার।
এখানে বলা হয়েছে আদিম মানুষ শিকার নির্ভরশীল ছিল। অযোধ্যা পাহাড় শিকারের প্রশস্ত অঞ্চল ছিল।

৩.  কিংবা লয়ে আলি রে মন কিবা লয়ে          যাবি ,
       এমন সুন্দর দেহ মাটিতে মিশাবি ,
       রে মন , এ ভব সংসার ছারি যাবি। 
এখনে বলা হয়েছে জীবন বড়ই ক্ষণস্থায়ী , একথা জেনেও মানুষ হতাশ হয় না। বরং তারা হাসে , গায় , নাচে। তারা ঈশ্বরে বিশ্বাসী ; ঈশ্বর যা বিহিত করবেন , তাই হবে। তাই বলে উপবাসী রেখে কৃচ্ছ্র সাধনায় প্রানের সমস্ত কোলাহলকে নিস্তব্ধ করে দিতে হবে , তা তারা স্বীকার করে না।

কৃতজ্ঞতা স্বীকার -
 ঝাড়খন্ডের লোক সাহিত্য
 (বঙ্কিমচন্দ্র মাহাত )

      



No comments:

Post a Comment